কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগ: নেতাদের আশাবাদ বনাম বিশ্লেষকদের সতর্কতা
ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়ার পর ভারতে অবস্থান করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে অথবা বিদেশে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের ইতিহাসের অন্যতম কঠিন সময় পার করছে। দলের তৃণমূল ও মধ্যম সারির নেতারা সাংগঠনিক শক্তি ধরে রাখার দাবি করলেও, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন—বর্তমান পরিস্থিতিতে দলটির ঘুরে দাঁড়ানো অত্যন্ত কঠিন চ্যালেঞ্জ।
কাজের ‘প্যাটার্ন’ পরিবর্তন: গোপনে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা
প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে না পারলেও দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম থেমে নেই বলে দাবি করছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে কাজের ধরনে পরিবর্তন আনতে হয়েছে তাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এক নেতা বলেন, "কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আমরা প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করতে পারছি না। এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের দলীয় কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বরং আমরা আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছি। তবে সঙ্গত কারণেই কাজের প্যাটার্ন কিছুটা পরিবর্তন করতে হয়েছে।"
নেত্রীকে দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করার বিষয়েও সন্দিহান দলটির কর্মীরা। ওই নেতা আরও বলেন, "সাজা ঘোষণা করা হলেও আমাদের নেত্রীকে দেশে ফিরিয়ে এনে সেটি কার্যকর করা এই সরকারের পক্ষে সম্ভব না বলে আমরা মনে করি।"
ঐক্যের বার্তা ও শেখ হাসিনাকে ঘিরে আশা
দলের ভেতরে ভাঙন বা বিভক্তির গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, আওয়ামী লীগ এখনো ঐক্যবদ্ধ।
"আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ আছে, ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য দলে যায়নি। তবে নানান চেষ্টা-অপচেষ্টা ও অপতৎপরতা আছে। এত সবকিছুর পরেই আমি মনে করি, শেখ হাসিনাকে ঘিরেই বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়াবে।"
বিশ্লেষকদের চোখে ‘অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ’
আওয়ামী লীগ নেতারা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমান বাস্তবতায় সহসাই তা সম্ভব নয়। বিশেষ করে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি বা ‘লিডারশিপ ভ্যাকিউম’ একটি বড় সংকট তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সাব্বীর আহমেদ বলেন, "তাদের সেন্ট্রাল লিডার (কেন্দ্রীয় নেতা) তো মোটামুটি গোটা পঞ্চাশেক। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা তাদের কারো পক্ষেই আগামী পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে সম্ভব হবে কি-না, এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।"
ভাবমূর্তি সংকট ও জুলাই অভ্যুত্থানের দায়
সাংগঠনিক দুর্বলতার চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে দলটির ভাবমূর্তির সংকট। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং সে সময়কার প্রাণহানির ঘটনায় দলের অবস্থান সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রাণহানির ঘটনায় অনুশোচনা প্রকাশ বা ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে, দলটির নেতারা এখনো সেটিকে ‘দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। অধ্যাপক সাব্বীর আহমেদের মতে, শেখ হাসিনার সামনে দলকে বাঁচানোর একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল।
"শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মৃত্যু হলেও তিনি দলকে অন্তত বাঁচাতে পারতেন যদি জুলাই আন্দোলনের প্রাণহানির দায় নিজে স্বীকার করে নিয়ে দলের সভাপতির পদ থেকে নিজেই সরে যেতেন। কিন্তু তিনি সেটা না করে উল্টো পথেই হাঁটছেন।"
সময় যত গড়াচ্ছে, আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়া ততই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। একদিকে নেতাদের গোপন তৎপরতা ও ঐক্যের দাবি, অন্যদিকে জনরোষ ও নেতৃত্বের শূন্যতা—এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী এই দলটির ভবিষ্যৎ।
0 Comments